মার্কিন ডলারকে আমেরিকা কিভাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করল? ডলার কেন বিশ্বমুদ্রা? 

আমেরিকার কোন রাজাবাদশাহ এসবের কিছু করেন নি। হ্যারী ডেক্সটার হোয়াইট নামের এক অর্থনীতিবিদ চাকুরি করতেন আমেরিকার স্টেট ডিপার্ট্মেন্টে। অসম্ভব চালাক মানুষ। পেটের কথা যেন বার না হয়, সে জন্য আসল কথা গোপন রেখে তিনি তাঁর পি-এইচ-ডি সন্দর্ভে ফ্রান্সের মুদ্রার ইতিহাস নিয়ে লিখলেন। কাউকে কিছু না বুঝিয়ে তিনি ১৯৪৪ সালে একটা প্ল্যান বানালেন, আর ভারতসহ (ভারত তখনও ইংল্যান্ডের ডমিনিয়ন ছিল) ৪৪টা দেশের প্রতিনিধিরা এসেছিলেন নিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রেটন উডস বলে এক জনবিরল স্থানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে।

তখন হোয়াইট সাহেবের প্ল্যানের বিরোধিতা করার মত বুদ্ধি নিয়ে কেউ যান নি সেখানে, যদিও ইংল্যান্ডের পক্ষে সেকালের সবচেয়ে নামযাদা অর্থবিশারদ জন মেইনার্ড কেইন্স উপস্থিত ছিলেন। সোজা বাংলায়, কেইন্সের উপর খুব বড় টেক্কা মারলেন হোয়াইট। তাঁর প্ল্যান অনুসারে আই-এম-এফ, বিশ্বব্যাঙ্ক, আর ডব্লিউ-টি-ও (বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা) তৈরি হয়, হোয়াইট হন আই-এম-এফ এর প্রথম নির্বাহী পরিচালক। আর বলা যায় তিনি একাই আমেরিকার ডলারকে বিশ্বমুদ্রায় পরিণত করেন।

আমেরিকার রাজনীতিবিদ্গণ তাঁর সাথে বেঈমানি করেন। যার কারণে আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি, সেই হোয়াইটকে সিনেটর্ ম্যাকার্থি নামের এক দানবীয় লোক রাশিয়ার চর বলে অভিযোগ করেন। হোয়াইটের হার্টের সমস্যা ছিল- আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে হার্ট এট্যাক হয়ে তিনি মারা যান ১৯৪৮ সালে।

 প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি
প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি

কেনেডি (জন এফ) প্রেসিডেন্ট হয়ে অর্থনীতির কিছু না বুঝে ডলারের সর্বনাশ করে দিয়েছিলেন, কিন্তু বিরাট ক্ষতি হবার আগেই তিনি মারা যান। ইউরোপের চালাক লোকে ডলারের বিকল্প ইউরো-ডলার বানাতে শুরু করে। সেটা এক অবিশ্বাস্য জিনিস— ইউরো ডলার কাগজে পত্রে আমেরিকার ডলার, কিন্ত এর একটাও ছাপানো নয়, সবটাই ব্যাংক একাউন্টে লেখা মাত্র। এটা বানাচ্ছিলেন ইউরোপের লোকেরা (মূলত লন্ডনবাসী ইহুদি ব্যাংকারগণ)। বাংলাদেশের লোকের বুদ্ধি যদি থাকত তাহলে তারাও এই অশরীরি ডলার বানাতে পারতো।

যাই হোক, নিক্সন এসে সেই সর্বনাশ ঠেকাতে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানিকে ঘুষ দেন, যার নাম হল স্পেশাল ড্রয়িং রাইট (এস-ডি-আর), যা পেয়ে তারা ইউরোডলার বানানো বন্ধ করে দেন। (ইউরোডলার বানাতো বেসরকারী ব্যাংকগুলি; কিন্তু সরকার আইন করে তা বন্ধ করে দেয়)। চক্ষুলজ্জার খাতিরে দুনিয়ার সব দেশকেই নামেমাত্র এস-ডি-আর ভিক্ষা দেওয়া হয়, কিন্তু জার্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড বিরাট আকারের এস-ডি-আর পায়। এটা নিখাদ ঘুষ।

আপনি তিনটা জিনিস একসাথে করে দেখেন। একনম্বরে হোয়াইট সাহেবের অসামান্য বুদ্ধির মার, যার কাছে সারা দুনিয়া পরাস্ত। দুই নম্বরে যান্ত্রিকতা— একমাত্র একটা ব্যাংকেই দুনিয়ার সকল দেশের একাউন্ট আছে, আর শুধুমাত্র অশরীরি ডলার সে ব্যাংকে লেনদেন হয়। এর নাম ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ নিউ ইয়র্ক (ফেডনি)। এই ব্যাংক না থাকলে কাগজ ছাড়া ডলার চালানোর কোন উপায় ছিল না। ছাপানো ডলার দিয়ে ব্যবসা করা আসলে অসম্ভব। সারা দুনিয়ার ৫ কোটি জালনোট কারিগর দিন রাত জাল ডলার বানালে তাদেরকে ঠেকাবে কে? আর মনে রাখবেন, লক্ষ কোটি ডলার লোন দিবার মত বুকের পাটা না থাকলে ফেডনি চালানো যাবে না। তিন নম্বর হল এস-ডি-আর নামক ঘুষ।

চীন, জাপান, জার্মানি এমনকি ভারত ইচ্ছা করলে ডলার বর্জন করে তাদের মুদ্রা দিয়ে সারা বিশ্বে লেনদেন চালাতে পারে, কিন্তু হোয়াইট সাহেবের মাথা কি চীন-ভারত-জার্মানি-জাপানের লোকের ঘাড়ে আছে?

আপনি নিশ্চিত থাকুন যে হোয়াইট সাহেবের মাথা অন্য লোকের ঘাড়ে নেই। আর তার সাথে যোগ করুন রথচাইল্ডের কলিজাঃ ভারতের লোক অন্য দেশের লোকদের কাছে দশ লক্ষ কোটি ডলারের সমান মূল্যের রুপি খুব কম সুদে (ধরুন ৩% সুদে) ঋণ দিতে রাজি তো?

আমার বিচারে দুনিয়ার ইতিহাসে দুইজন লোক টাকার রহস্য জানতেন। তাদের সেরা ছিলেন হ্যারী ডেক্সটার হোয়াইট। অন্য জন ছিলেন স্যরা টমাস গ্রেশাম। আর কেউ টাকার রহস্য জানেন না।

হ্যারী ডেক্সটার হোয়াইট
হ্যারী ডেক্সটার হোয়াইট

Harry Dexter White – Wikipedia

স্যরা টমাস গ্রেশাম
স্যরা টমাস গ্রেশাম

Thomas Gresham – Wikipedia

উপরের লিঙ্কে গিয়ে এই অসম্ভব বুদ্ধিমান লোকটিকে সালাম জানাবেন আশা করি।

দুনিয়াতে ৭৮০ কোটি মানুষের মাঝে ৭৮০ জনও নাই যার মাথায় এই বুদ্ধিটা আসবে যে ছাপানো কাগজ বাদ দিয়ে লেনদেন করতে হলে একটা ব্যাংক থাকা দরকার যেখানে সব দেশের একাউন্ট থাকবে। ইউরোকে বিশ্বমুদ্রা করা গেলনা শুধু এই কারণে যে কোথাও এমন ব্যাংক নাই যেখানে এক দেশের একাউন্ট থেকে অন্য দেশের একাউন্টে ইউরো পাঠানো সম্ভব। খবর নিলে দেখবেন ইউরো বানাবার বুদ্ধি যিনি দিয়েছিলেন তিনি হলেন কানাডায় জন্ম নেওয়া আমেরিকান ইকোনোমিস্ট

Robert Mundell
Robert Mundell

Robert Mundell – Wikipedia

বাই দ্য ওয়ে, হোয়াইট আর গ্রেশাম দুজনেই ছিলেন ইহুদি। টাকা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমি জানলাম ব্যাংকিংয়ের আগে হুন্ডি আবিষ্কার করেছিলেন ইহুদীরা, ব্যাংকিং তাদের আবিষ্কার, আর বলতে গেলে ফাইনান্সের যত বিবর্তন হয়েছে, তার প্রায় সবটাই ইহুদিদের কীর্তি। আমার জানা মতে কোন মুসলমান বা হিন্দু টাকা সম্বন্ধে কিছু জানেন না, একদম কিচ্ছু না। সৌদী আরব-কুয়েত-ইরান-ইরাক-লিবিয়া মিলে তেলের কুপনকে টাকায় পরিণত করতে পারতো, কিন্তু জানলে তো সেটা হবে। সোনার পিন্ডকে ভাঁওতা হিসাবে নিয়ে সোনার কুপনকে ডলার বানাবার বুদ্ধি যাদের ছিল, তারা জানতেন যে আসলে কেউ সোনা নিতে আসবে না, আর আসেও নি। ১৯৪৪ সালে ভাঁওতা ছিল ৩৫ ডলার জমা দিলে এক আউন্স সোনা দেওয়া হবে, কিন্তু কেউ তো সোনা চায় নি, কাজেই কাগজের কুপন বা নোট দিয়েই কারবার চলেছে। তেলের কুপনকে কিছু ইহুদি টাকা বানিয়েছেন, কিন্তু সৌদিদের কারও মাথায় এই ধারণা আসবেইনা যে তেলের কুপন টাকা হয়ে গেলে লোকে সেই কুপন ভাঙ্গিয়ে তেল নেবেনা, তেলের জায়গায় তেল পড়ে থাকবে, আর কুপন দিয়ে লোকে তেল ছাড়া অন্য সবকিছু কিনবে।

(ফ্রান্সের দ্য গল ডলার ভাঙ্গিয়ে সোনা নিয়ে মহা বিপদে পড়েছিলান। ফ্রান্সই দুনিয়াতে একমাত্র দেশ যার সোনার ভান্ডার আমেরিকার পাহারায় আমেরিকাতেই আছে দুই মাইল মাটির নীচে, আর সেই ১৯৬৮ সাল থেকে ফ্রান্স আমেরিকাকে সোনা পাহারার মজুরি দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যদি সোনা না নিয়ে কাগজের ডলার রাখতো, তাহলে ফ্রান্স উলটো কিছু সুদ পে্তো। সোজা কথা, ফ্রান্স সুদ তো পায় না, বরং জরিমানা দেয়। এটা হল ডলারের বদলে সোনা নেওয়ার উচিত শাস্তি, নির্বুদ্ধিতার জরিমানা।)

মনে রাখবেন, ইউরো নিতে চাইলেই ইউরো চালু হবেনা (ইউরোপের বাইরে সারা দুনিয়ায়) যদি ইউরো দিবার জন্য একটা ব্যঙ্ক না থাকে। ধরুন বাংলাদেশকে ১০ কোটি ইউরো দিতে চায় জার্মানি। কিন্তু দিবার কোন উপায় নাই, কারণ ছাপানো কাগজ চলে না। তাহলে এমন একটা ব্যাংক লাগবে যেটায় জার্মানির একাউন্ট আছে, আবার বাংলাদেশের একাউন্ট আছে। তেমন ব্যাংক দুনিয়ার ঐ একটাই— ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অফ নিউ ইয়র্ক। আর সেই ব্যাংকে ইউরো বলে কিছু নেই— জার্মানির একাউন্ট থেকে ডলার নিয়ে বাংলাদেশের একাউন্টে ডলার দেওয়া হবে। ইউরো চলাচলের কোন রাস্তা সেখানে একদম নেই। (ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ভেতরে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক সেই রাস্তা করেছে, কিন্তু সেটা ইউরোপের বাইরে যায় না।) টাকার বিষয়টা এতোই প্যারাডক্সিক্যাল, কাউকে বুঝানোর চেষ্টা করা বৃথা। 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here