বিদেশ যাত্রায় প্রতারণা থেকে সবাই নিরাপদ থাকবেন কিভাবে?

দেশের প্রতিটা তরুণ স্বপ্ন দেখেন সুন্দর ভবিষ্যত নিয়ে। আর সেই তরুণদের বেশ বড় একটা অংশ বিদেশে পাড়ি জমান স্বপ্ন নিয়ে। একটা সময় ছিল তথ্য প্রযুক্তির এত ব্যাবহার ছিল না মানুষ অন্ধভাবে কারো উপর ভরসা করে টাকা আর পাসপোর্ট তুলে দিতে বিদেশ আসার জন্য, সেই যুগ আর এই যুগের মধ্যে আকাশ পাতাল দুরী রয়েছে। বিদেশ যাত্রায় আগেও প্রতারণা ছিল বর্তমানেও আছে। শুধু পাল্টেছে প্রতারণার ধরন।

বিদেশগামি বাংলাদেশী নাগরিকদের অধিকাংশ কোথাও না কোথাও ধরা খেয়েছেন কিংবা প্রতারণার স্বীকার হয়েছেন এমন গল্প তাদের মুখে শুনে থাকি। কিন্তু কিভাবে প্রতারিত হয়েছেন জানতে গেলে বেরিয়ে আসে অনেক রকমের তথ্য যা সমাজের আরও মানুষের মঙ্গলার্থে শেয়ার করা দরকার মনে করছি।

বিদেশ যাত্রায় প্রতারিত হন বা নানা হয়রানির স্বীকার হন প্রায় ৫১ শতাংশ  মানুষ।  শরণার্থী অভিবাসন বিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) গবেষণা বলছে, বিভিন্ন দেশে অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রায় ৫১ শতাংশই বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। প্রতারণার শিকার শতকরা ৫১ ভাগের মধ্যে শতকরা ১৯ ভাগ মানুষ টাকা দেওয়ার পরও বিদেশে যেতে ব্যর্থ হয়েছেন। বাকি শতকরা ৩২ ভাগ বিদেশে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। প্রতারণার শিকার বাংলাদেশিরা গড়ে লাখ ৪৩ হাজার ২৪৭ টাকা করে হারিয়েছেন।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় এধরনের ঘটনা সবসময়ই হচ্ছে। বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) গবেষক অভিবাসন বিশেষজ্ঞ . জালাল উদ্দিন শিকদার বলেন, আমাদের অভিবাসন আইনে এই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে কঠিন শাস্তির কথা বলা আছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। অভিবাসন আইনে কি কোনও মামলা হয়েছে আজ পর্যন্ত? অথবা মামলা হলেও একটি উদাহরণ দেখানো যাবে না যে, আইন প্রয়োগে সাজা পেয়েছে, যাকে আমরা দৃষ্টান্ত বলতে পারি।তিনি আরও বলেন, যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে শক্ত একটা অবস্থান নিয়ে অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু সেক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।

 কিভাবে আপনি প্রতারণা থেকে বাঁচতে পারবেন

কোন প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার আগে ভালভাবে যাচাই বাছাই করা।

ধরুন আপনি কোন একটা দেশের জন্য আপনার পাসপোর্ট ও প্রযোজনীয় ডকুমেন্টস কারো কাছে জমা করবেন। পত্রিকায় লোভনীয় বিজ্ঞাপন কিংবা অনলাইনে চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে তার দারস্হ হবে না। দেশে এমন হাজারো এজেন্সি আছে যারা বিদেশে লোক পাঠানোর নামে প্রতারণায় জড়াচ্ছে কাজ শুরুর আগে তাদের ব্যাপারে খুঁজ নিজ তাদের আগের কাজের অভিজ্ঞতা, কোন দেশে কি ভাবে লোক পাঠায় বিস্তারিত তথ্য জানুন।

অনলাইনে পরিচয় হয়েছে অথচ বাস্তবে চেনেন না এমন বাক্তির সাথে লেনদেন থেকে বিরত থাকুক।

তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে সবাই সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাবহার করে। বাবসা বাণিজ্য চলে অনলাইনেও। অনেকে  আবার যারা বিজনেস করেন তাদের অবশ্য বিজনেস পেইজ থাকে সেই সুবাদে তাড়া নানা তথ্য, নিজেদের বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকেন। বর্তমানে প্রতিটা মানুষের / টা পেইজ থাকে আর গ্রুপের অভাব নাই। ভিসা বিজ্ঞাপন আজকাল অহরহ নামে বেনামে গ্রুপ খুলে করে যাচ্ছে। অনলাইনে অনেকে তথ্য শেয়ার করে সেই সুবাদে আপনি মনে করছে সে ভাল কাজ করে হয়ত এই ভেবে তার সাথে লেনদেনে জড়ালেন কিন্তু ভার্চুয়াল প্লাটফর্ম ছাড়া আপনি তার ঠিকানা  পরিচয় কিছু জানেন না। এমতাবস্থা আপনি তার কাছে কাজ দেয়ার আগে তার কোন ঠিকানা, প্রতিষ্ঠান আছে কিনা খুঁজ নেন। যদি কিছু না থাকে লেনদেন থেকে বিরত থাকুন।

ধরা ছোঁয়ার বাহিরে এমন বাক্তির সাথে লেনদেন না করা

আপনি অনেক ক্ষেত্রে অনলাইনে অমুক দেশের তমুক দেশের বিজ্ঞপ্তি দেখে থাকেন অবশ্যই আপনি জানেন না তাদের কাজ কিংবা আধো কোন প্রতিষ্ঠান আছে কিনা। গোগলে দেয়া থিকা কিংবা অনলাইনের ফোনবুক  থেকে নাম্বার নিয়ে কোন প্রকান লেনদেনে যাবেন না। গেলে প্রতারণার সম্বাভনা থাকে বেশি। আজকাল ফেইসবুক খুললেই দেখি জব ইন ক্রোয়েশিয়া, জবস ইন রোমানিয়া, জবস ইন ইউরোপ নামের হাজারো গ্রুপ, পেইজ নানা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। আপনি তাদের দেয়া ঠিকানা কিংবা প্রতিষ্ঠান ট্র্যাক করতে পারবেন না যতক্ষণ আপনি তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন। আজকাল প্রতারণার অন্যতম মাধ্যম হল এমন সব গ্রুপ পেইজ, ভার্চুয়াল প্লাটফর্ম ছাড়া তাদের কোন অস্তিত্ব নেই, তাদের দেয়া ঠিকানা গোগলে পাবেন কিন্তু বাস্তবে নেই, কিংবা ফোন নাম্বার দিয়ে শুধু whats up পাবেন বাস্তবে কল দেয়ার কিছু পাবেন না। এমন সব বাক্তির সাথে লেনদেন নয়।

কাগজ পত্র যাচাই (ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট ইত্যাদি ) এর আগে মোটা অংকের লেনদেন নয়।

একটা দেশের ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করাটা ভিসার জন্য মেইন কাজ। আর ইউরোপের কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে একটু পার্থক্য আছে। ইউরোপে ওয়ার্ক ভিসার জন্য বাধ্যতামূলক আগে ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করতে হয় আর মধ্যপ্রাচ্যে সরাসরি ভিসা নেয়ার সুযোগ আছে।এখন কথা হল ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু হলে কি আপনি ভিসা পাবেন বা এই শর্তে মোটা অংকের টাকা দিয়ে দিবেন ? না এই কাজ কখনোই করবেন না। একটা দেশের ভিসার আবেদনের আগে ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করতে যে টাকা টা খরচ হয় তা দেশ বেধে ৫০ ইউরো থেকে ৩০০ ইউরো হয়ে থাকে। সেই ক্ষেত্রে এজেন্ট আপনার থেকে ৫০০৬০০ ইউরো নিতে পারে। আপনাকে যদি মোটা অংকের টাকার ব্যাপারে বলা হয় আপনি একটু সতর্ক হবেন নিজ থেকে। প্রতারিত হবার সম্ভাবনা থাকবে এই ক্ষেত্রে। কিংবা কোন কারণে পারমিট পেলে ভিসা না হলে আপনি টাকাটা সহজে তাদের থেকে নিতে পারবেন না, অতএব বুঝে লেনদেন করুন।

ফেইক বিজ্ঞাপন /অফার / অসম্ভব রকমের লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেখে আকৃষ্ট নয়।

কোন দেশের ব্যাপারে যখন আপনাকে অফার দেয়া হবে যে আপনাকে ভিসা করে দেয়া, তাদের কথায় ফাঁদে না পরে নিজে যাচাই করুন আসলে যে দেশের ব্যাপারে আপনাকে বুঝান হচ্ছে বাস্তবে দেশে লোক পাঠানো যায় কি না জব ভিসায়। আমি একটা উদহারন দেই। 

ধরুন কোন এজেন্সি আপনাকে বললও আপনাকে কানাডায় eTA (ইলেকট্রনিক ট্র্যাভেল আথরাইজেশন ) দিয়ে কানাডা পাঠিয়ে দিবে কিংবা নিউজিল্যান্ড কাজের ভিসায় পাঠাবে eTA দিয়ে। আপনি না জানলে তাদের কথা সত্য ধরে টাকা লেনদেন শুরু দিবেন অথচ বাস্তবে ভিন্ন জিনিস, কানাডায় eTA নিয়ে বাংলাদেশী পাসপোর্ট হোল্ডারদের কোন সুযোগ নাই, যদি ভিসা অয়েভার প্রোগ্রামে কানাডার সাথে চুক্তিবদ্ধ দেশ (যেমন ইউ দেশ গুলো ) কেউ কানাডায় eTA নিয়ে যেতে পারে না। সো আপনাকে সতর্ক থাকা লাগবে প্লাস যাচাই বাছাই করার ক্ষমতা থাকতে হবে।

২য় কথা যখন আপনাকে কেউ ধনী দেশ গুলোর ওয়ার্ক পারমিট ভিসা অফার করবে, যেমন আমেরিকা, কানাডা, নরওয়ে সুইডেন, ডেনমার্ক  সমস্ত দেশে আপনাকে নন স্কিল  জব ভিসায় পাঠানোর অফার দিবে আপনাকে চোখ কান খুলা রাখতে হবে, কেননা এই সমস্ত দেশে জেনারেল ভিসার সুযোগ নেই, আর যেই প্রক্রিয়ায় হয় সেটা সময় সাপেক্ষ / মাস পরে পাঠিয়ে দেবে এমন সব কথাবার্তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কাজেই প্রতারণার বিষয় থেকে যায়।

রিচ পেমেন্ট/পৌঁছানোর পর টাকা এই চুক্তিতে কাজ  না করা

আমরা অনেকে শুনে থাকি রিচ পেমেন্ট সম্পর্কে, যতটা সহজ শুনা যায় ব্যাপারটা পৌঁছানোর পর টাকা আসলে এত সহজ হয় না শেষ পর্যন্ত জিনিসটা। আমরা পথিমধ্যে দালালরা আটক রেখে মারধরের ঘটনা প্রায়ই শুনে থাকে, কিংবা দালালরা বিক্রি করে দিয়েছেন, জিম্মি করে পরিবার থেকে মুক্তিপণ আদান করে এমন সব ঘটনা মূলত যারা রিচ পেমেন্টে বিদেশ আসে তাদের সাথে হয়ে থাকে। এই ধরনের ঝামেলা/হয়রানি/ প্রতারণা থেকে বাঁচতে আমাদের বৈধ পথে বিদেশ আসতে হবে।

বৈধ রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির  সেবা নিয়ে বিদেশ আসুন।

বিদেশ পাঠানোর জন্য সরকার নির্ধারিত রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি আছে দেশে। বিশেষ করে কূটনৈতিক রিলেশনের মাধ্যমে যেসব দেশের সাথে লোক পাঠানোর চুক্তি হয় সেসব দেশে এই রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি গুলো  লোক পাঠাতে পারে। দেশের প্রতিটা জেলা পর্যায়ে তালিকা আছে কারা বিদেশে লোক পাঠাতে পারে। জেলা কর্মসংস্থান ব্যুরো অফিসের মাধ্যমে আপনি এসব লিস্ট পাবেন মূলত।

বৈধ চুক্তিপত্রের মাধ্যমে কাজ করুন।

আমরা সচারাচর শুনে থাকি অমুক প্রতিষ্ঠানে ফাইল দিয়েছি তমুক প্রতিষ্ঠানে কাজ দিয়েছি। অথচ দুই পক্ষের মধ্যে কোন চুক্তিপত্র হয় নি না করার দরকার মনে করেননি। এইখেত্রে উত্তম দুইপক্ষের চুক্তিপত্র করা।  আমরা এমন কাহানী শুনেছি ইউরোপের কোন দেশের ভিসার জন্য মুখিক ভাবে লাখ টাকা দেয়ার কথা হয়েছিল কিন্তু এজেন্ট ভিসার পরে লক্ষ্য টাকা নিয়েছিল ক্লাইয়েন্ট থেকে। চুক্তিবদ্ধ হয়ে আইন অনুযায়ী লিখিত নিয়ে থাকলে এমনটা করার সুযোগ থাকত না, অতএব এটা জরুরী উভয় পক্ষের জন্য।

সর্বপরি বিদেশ যাত্রায় আমাদের সচেতনতা দরকার, চোখ কান খুলা রাখা দরকার। অভিবাসন হোন নিরাপদ ঝুকিমুক্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here